হাসি তামাশার ভয়াবহ পরিণাম-উম্মাহ টাইমস ২৪. কম
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে বিশ্বাসী বান্দাগণ! তোমাদের কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গোনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম।”
এ আয়াত পূর্ববর্তী বুযুর্গ ও মনীষীদের অন্তরে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। যেমন, হযরত আমর বিন শোরাহ বিল (রাহঃ) বলেন, কোন ব্যক্তিকে বকরীর স্তনে মুখ লাগিয়ে দুধ পান করতে দেখে যদি আমার হাসির উদ্রেক হয়, তবে আমি আশংকা করতে থাকি যে, না জানি আমিও এরূপ হয়ে যাই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, কোন কুকুরকেও আমার উপহাস করতে ভয় লাগে। এ জন্য যে, আমিও কিনা আবার কুকুরে পরিণত হয়ে যাই (কুরতবী)
যা হোক, এবার আমরা ঠাট্টা ও ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের করুণ পরিণতি সম্পর্কীয় একটি ঘটনা শুনি।
সুন্দর-সুশ্রী সুঠাম দেহের অধিকারী ফুটফুটে এক ছেলে। নাম ইরফান। পড়াশুনায় মোটামুটি ভাল। তার পিতা ইনকাম টেক্সের একজন উকিল। সেই সুবাদে অভাব কি জিনিষ তা কোনদিন সে টের পায়নি। কিন্তু তার একটি মারাত্মক দোষ এই ছিল যে, সে সর্বদা অহংকারবোধ নিয়ে চলাফেলা করত এবং গরীব ও মধ্যবিত্ত ছাত্রদের নিয়ে অহর্নিশ উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রুপ করে বেড়াত।
তার সাথে যোগ দিত আরো কয়েকজন ধনীর দুলাল। তারা সকলেই ছিল ইরফানের মতই অহংকারী। তবে ইরফান ছিল সেই দলের নেতা।
একদিন তাদের স্কুলে রশিদ নামের একটি নতুন ছাত্র ভর্তি হল। তার গায়ের রং ছিল অত্যন্ত কালো। ইরফানের কয়েকজন সাথী ছেলেটিকে দেখে দৌঁড়ে এসে তাকে বললো, “আমাদের স্কুলে একজন নতুন ছেলে ভর্তি হয়েছে। তাকে দেখে কেউ কেউ বলছে, সে নাকি আফ্রিকার জঙ্গল থেকে পলায়ন করে এসেছে।”
ইরফান তো সর্বদা এ জাতীয় সংবাদের অপেক্ষাই থাকে। সুতরাং সংবাদ পেয়ে আর দেরী নেই। সাথে সাথে সাথীদের নিয়ে ছুটল ছেলেটিকে দেখার জন্য। ছেলেটিকে দেখেই মনে হল, সে যেন বড় এক শিকার পেয়ে গেল। তাই সে প্রথমেই ছেলেটিকে “মিস্টার নিগ্রো” বলে সম্বোধন করল। (আফ্রিকার কাল বর্ণের লোকদেরকে নিগ্রো বলা হয়)।
ইরফানের এই প্রাথমিক সম্বোধন নবাগত ছাত্র রশীদের হৃদয়কে। মারাত্মক ভাবে আহত করলো। ব্যথায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তার হৃদয়- মন। শেষ পর্যন্ত এই ব্যথা তার দু’চোখকে অশ্রু-সজল করে তুললো। টপ। টপ করে দু’ফোটা অশ্রু ইরফানদের সামনেই গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এতে। তাদের মনে একটু দয়া-মায়া সৃষ্টি হয়নি। তারা একের পর এক বিভিন্ন।
বাক্যবানে রশিদের অন্তরকে চৌচির করতে লাগলো। কিন্তু তারা একটি বারের জন্যও চিন্তা করলো না যে, কালো কিংবা ফর্সা হওয়া মানুষের এখতিয়ারভূক্ত কোন জিনিষ নয়। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তিনি যাকে যেমন চান তেমনই বানান।
যা হোক রশিদ এক পর্যায়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, ভাই আমার নাম তো রশিদ। আমাকে মিঃ নিগ্রো বলে সম্বোধন করছ কেন? তার কথায় ইরফান সহ উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। ইতিমধ্যে তাদের শ্রেণী শিক্ষক আফজাল সাহেব ক্লাসে প্রবেশ করে হাসির কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইরফান এ কথা ও কথা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পাশের একটি ছোট ছেলে বলে উঠলো, স্যার সে মিথ্যা বলছে। রশিদ ভাই কালো হওয়ার কারণে তাকে নিয়ে ওরা হাসছিল। একথা শুনতেই আফজাল সাহেব বেত নিয়ে ইরফান কে মারার জন্য উদ্যত হলেন। কিন্তু রশিদ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে দরদ মাখা কণ্ঠে বললো, ” স্যার! অনুগ্রহ করে ইরফান ভাইকে ক্ষমা করে দিন।” এ কথায় স্যারের রাগ থেমে গেলে তিনি ইরফানকে ক্ষমা করে দিলেন।
এ আচরণের পর যেখানে রশিদের প্রতি ইরফানের ভালবাসা ও মমতা বৃদ্ধির কথা ছিল সেখানে শত্রুতা ও বিরোধীতা এসে ভীড় জমাল। কেননা সে যে এক চরম অহংকারী। তার কথা হল যার কারণে স্যার আমাকে মারতে আসলেন তার আর রক্ষা নেই। সুতরাং সে রশিদের চরম শত্রুতে পরিণত হল এবং সেদিন থেকে নিয়মিত তাকে’ মিঃ নিগ্রো’ বলে সম্বোধন করতে লাগলো।
রশিদ সীমাহীন ধৈর্যশীল ছেলে বিধায় ইরফানের এ আচরণে মনে দারুণ কষ্ট পেলেও কোন দিন সে এ ব্যাপারে স্যারের নিকট নালিশ করেনি। ফলে ইরফান দিন দিন আরো বেশী বেপরোয়া হয়ে গেল।
আল্লাহ তায়ালা তো বান্দার সব আমলই সর্বদা প্রত্যক্ষ করছেন। তাইতো ইরফানের দেয়া সকল উপহাস ও ব্যঙ্গ বিদ্রূপকে রশিদ অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে মেনে নিলেও তিনি হয়তো তা সইতে পারেন নি। ফলে ইরফানকে এমন এক মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হতে হল যার কারণে মৃত্যু পর্যন্ত কোন দিন সে সমাজে মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারেনি।
সেদিন ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসের দিন। ইরফান তার অন্যান্য সাথীদের নিয়ে বিজ্ঞানাগারে প্রবেশ করে রাসায়নিক দ্রব্য ও এসিড নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল। এমন সময় হঠাৎ সে টেবিলের উপর রাখা গরম পানির পাত্রের সাথে ধাক্কা খেল। এতে পাত্রটি নীচে পড়ে গেল এবং ফুটন্ত পানি ছিটকে এসে তার চেহারায় পড়লো। সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে ইরফান তার চেহারা ঢেকে ফেলল।
ইরফানকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলো। দেখা গেল, প্রচন্ড গরম পানি ফুটফুটে সুন্দর চেহারাটিকে সীমাহীন কুৎসিত কালো চেহারায় পরিণত করে দিল। ইরফানের আব্বা চেহারার স্বাভাবিক সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করলেন। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না।
অহংকারী ইরফান তার এই চেহারা বিকৃতি কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না। ফলে বাড়ীতে বসেই সময় কাটাতে লাগলো সে। এভাবে দু’বছর চলে গেল। ইতিমধ্যে সে শুনলো, রশিদ মেট্রিক পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম হয়েছে এবং তার অন্যান্য সাথীরাও কলেজে ভর্তি হয়েছে।
একদিন ইরফান তার পিতাকে বললো তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। তার কথা মত পিতা তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইরফান এবার কারো সাথে কথা বলে না। এমনকি বিরতির সময়েও ক্লাসের বাইরে যায় না। একদিন ক্লাস শেষে বইপত্র নিয়ে সে ক্লাসরুম থেকে বের হচ্ছিল। হঠাৎ তার কানে ভেসে এল “কে যেন বলছে, ভাই! এমন বিশ্রি চেহারা তো আর কোনদিন দেখিনি।” আরেকজন বলছে, “আমি তো এই কুৎসিত চেহারা দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।” এ কথাগুলো শুনে ইরফানের মনে হলো, কে যেন তার হৃদয়ে একের পর এক বর্শার আঘাত করে চলেছে।
ইরফান আজ বুঝতে পারলো, কাউকে উপহাস কিংবা বিদ্রুপ করলে হৃদয়ে কি পরিমাণ ব্যথা অনুভূত হয়। সাথে সাথে সে এ-ও বুঝলো যে, আমার এই করুণ পরিণতি নিশ্চয়ই ঐ নবাগত কালো ছাত্রটিকে উপহাস ও ঠাট্টা বিদ্রুপেরই ফল। যাকে দেখে সে মিঃ নিগ্রো বলে সম্বোধন করতো। তাই পাঠক-পাঠিকা ভাইবোনদের নিকট লেখকের পক্ষ থেকে বিনীত অনুরোধ এই যে, কেউ গরীব কিংবা কালো হলে অথবা যে কোন দিক দিয়ে নীচু স্থরের হলে তাকে অহংকার বশতঃ তাচ্ছিল্যের চোখে না দেখি এবং তাকে নিয়ে কোনদিন কখনো যেন উপহাস না করি। আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দিন। আমীন। ছুম্মা আমীন।